হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এসেছেন সৌম্য সরকার কিভাবে এবং কেন?
ইমার্জিং এশিয়া কাপের দল বাছাইয়ের সময় সৌম্যকে ডাকা হয়েছে সেই দলে। তবে সেই দলের সবাই যে সুবিধাটা পাচ্ছে না, সেটি আবার পাচ্ছে সৌম্য সরকার। সেই সুবিধাটি হল, ইমার্জিং এশিয়া কাপের দলে ডাক পেলেও সৌম্য অনুশীলন করছে বাংলাদেশের পরবর্তী ওয়ানডে সিরিজের দলের সাথে।
গুঞ্জন আছে চন্ডিকা হাতুরুসিংহের চাওয়াতেই ডাকা হয়েছে তাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সৌম্য ডাক পেয়ে করবেন টা কি? ওয়ানডে ভাবনায় তাকে কেন রাখা হল? তিনি কি এই সুযোগের প্রাপ্য?
একটু ফিরে গিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে চলে যাওয়া যাক। লিস্ট-এ টুর্নামেন্টের এই আসরে সৌম্য ছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ১১ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে তিনি এখানে করেছেন ২৬.৬৪ গড়ে মাত্র ২৯৩ রান। সৌম্যর স্ট্রাইক রেটটাও আবার এখানে নাঈম কিংবা বিজয়ের চেয়ে অনেক কম- ৮৩.২৪।
পুরো টুর্নামেন্টেই সৌম্য হাফ-সেঞ্চুরি করেছেন একটা আর সেঞ্চুরি করেছেন সমান একটা। সেই হাফ সেঞ্চুরিটা আবার এসেছিল অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে। এই ম্যাচে সৌম্য ওপেন করতে নেমে ৫৬ রান করতে তিনি খরচ করেছিলেন ৯১ বল! একমাত্র সেঞ্চুরির ম্যাচে লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জের বিপক্ষে সৌম্য করেছেন ১১২ বলে ১০২!
পুরো টুর্নামেন্টে এই দুটি ইনিংস ছাড়া আর কোথাও সৌম্য বলার মত রান করেননি। পুরো টুর্নামেন্টে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ১৬(১৯), আবাহনীর বিপক্ষে ১(৬), প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে ১৭(১৫), লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জের বিপক্ষে (১ম পর্বে) ৪১(২৬), শেখ জামাল ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে(১ম রাউন্ড) ৮(১২), সিটি ক্লাবের বিপক্ষে ১৩(২০), ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে ৯(১২), সুপার সিক্সে আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে ৮(৭), শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বিপক্ষে ২২(৩২)। এই রান নিয়ে সৌম্য ডাক পেয়েছেন সেমি-জাতীয় দলে।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরারদের মধ্যে সৌম্যর অবস্থানও দুঃখজনক- ৪৬ তম!
তবে পুরো টুর্নামেন্টে তার ব্যাটিং পজিশন অনেকবারই রদবদল হয়েছে। তবে একটি ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচেই তিনি ১ থেকে ৪ এর মধ্যে ব্যাট করতে নেমেছেন। এখানে অবশ্য আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার, মাত্র একটা ম্যাচেই তিনি চার নম্বরে নেমেছিলেন। তবে টপ অর্ডার ছাড়াও সৌম্যকে এক ম্যাচে লোয়ার অর্ডারেও ট্রাই করা হয়েছে এবং খুবই প্রত্যাশিতভাবে তিনি সাত নম্বরে ফেইল করেছেন। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বিপক্ষে তার স্কোর ছিল ১২ বল খেলে ৮ রান!
সৌম্য যে দুই ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছিলেন সেই দুই ম্যাচের একটা অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামা এই ম্যাচে অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে বল করেছিলেন মোট ৮ জন বোলার। তবে এদের মধ্যে আবু হায়দার রনি আর বোলিং একশনের কারণে ব্রাত্য হয়ে যাওয়া আরাফাত সানি ছাড়া আর কাউকেই আপনার চেনার কথা না। আবার এই যে ২ জন পরিচিত মুখ, এদের বিপক্ষেও সৌম্যর পারফরম্যান্স ভাল ছিল না। আবু হায়দার রনিকে ১২ বল ফেস করে ৭ বলই তিনি ডট খেলেছিলেন। বাকি ৫ বলে অবশ্য ৩ চার ও ২টা সিঙ্গেল নিয়ে তিনি ১৪ রান করেছিলেন। তবে আরাফাত সানির স্পিনে সৌম্যর দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মত। ১৯ বল খেলে সানির ১৩ বলই তিনি দিয়েছিলেন ডট। বাকি ৬ বলে ১ চার ও ৫ টা সিঙ্গেল নিয়ে তিনি নিয়েছিলেন ৯ রান। সৌম্য শেষ অব্দি নিজের উইকেটটা খুইয়েছিলেন এই সানির বলেই। সানি ছাড়াও অগ্রণী ব্যাংকের দলে যে স্পিনাররা ছিল, তাদের বলেও সৌম্য যে খুব একটা স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন এমনটা বলা যাবেনা। অফ স্পিনার মোহাম্মদ শরিফুল্লাহর ৩০ বলে তিনি নিয়েছিলেন মাত্র ১১ রান, সেখানে আবার ২০ টা বলই ছিল ডট। বাঁহাতি স্পিনার আজিম নাজিরের বিপক্ষেও সৌম্য ১৭ বলের ১২ টাই ডট দিয়েছিলেন, নিতে পেরেছিলেন ১৩ রান।
এবার সেঞ্চুরির ম্যাচে ফেরা যাক। টুর্নামেন্টের একদম শেষ দিকে লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জের বিপক্ষে সৌম্য সেঞ্চুরি করে ফেলে। ওপেন করতে নামা সেই ম্যাচে সৌম্যর পারফরম্যান্স ছিল এরকম-
মাশরাফির ২১ বলে ১২ টা ডট দিয়ে ১৩ রান
মুক্তার আলির ১১ বলে ২ টা ডট দিয়ে ১৮ রান
সোহাগ গাজীর ২০ বলে ১১ টা ডট দিয়ে ২১ রান
ডানহাতি লেগ স্পিনার জাওয়াদ রোয়েনের ২৯ বলে ১৭ টা ডট দিয়ে ১৫ রান
বাঁহাতি স্পিনার অনুপ কান্তি পালের ১৫ বলে ৯টা ডট দিয়ে ১৬ রান
ডিব্লি ডব্লি পেসার চিরাগ জানির ১৬ বলে ৭ টা ডট দিয়ে ১৯ রান
এই সারিগুলির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, স্পিনারদের বিপক্ষে রান করতে কতটা ধুকতে হয়েছে তাকে। এমনকি পড়ন্ত বেলায় মাশরাফিও যথেষ্ট ভুগিয়েছেন সৌম্যকে। শেষ অব্দি সৌম্যর উইকেট টা নিয়েছিলেন তিনিই।
আবার সৌম্যকে আমরা যে ফ্লাইং স্টার্টের জন্যে দলে চাই, সেটিও কিন্তু তিনি কোন ম্যাচেই এনে দিতে পারেননি। সেঞ্চুরির ম্যাচটাতে প্রথম দশ বলে তিনি করেছিলেন ৫ রান, সেটাও আবার ৫ বল ডট দিয়ে। পরের ১০ বলেও সৌম্য ডট দিয়েছিলেন ৭ টা বলে। এই ম্যাচে সৌম্যর ডট বলের হার ছিল ৫১.৭৯%! হাফ সেঞ্চুরির ম্যাচে সৌম্যর ডট বল রেট ছিল এটার চাইতেও বেশি- ৬৫.৯৩%। অনেকে অবশ্য পিচের কথাও বলতে পারেন। তবে এই পিচে ব্যাটিং করেই আবু হায়দার রনি ঐ ম্যাচে করেছিলেন ২৪ বলে ২২। এমনকি রিয়াদের ডট বলও এখানে ছিল সৌম্যর চেয়ে কম- ৪৩.৪৮%!
তামিম ইকবাল চাইলে তাই সৌম্যকে দেখে বলতেই পারেন, “ফাইনালি আ ওর্থি অপোনেন্ট…”
এখন প্রশ্ন হল এই ভঙ্গুর ফর্ম নিয়ে তিনি জাতীয় দলকে আসলে দেবেন টাই বা কি? তার কি আদৌ কিছু দেওয়ার আছে? তাকে নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট আসলে কি করতে চাইছে?
টিম ম্যানেজমেন্টের একটা চাওয়া হতে পারে এমন যে তারা হয়তো সৌম্যকে সাত নম্বরের জন্যে চাইছে। কিন্তু সৌম্য কি আসলেই এই রোলটা পালন করতে পারবে? সৌম্যকে নিয়ে লোয়ার অর্ডারে পাঠানোর প্রয়াস কিন্তু আগেও দেখা গেছে। সেখানে সৌম্য খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি। সাত নম্বরে নামা ৩ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় ১৫.৩, স্ট্রাইক রেট ৭৫.৪। এছাড়াও সৌম্যকে একবার ছয়ে ও আরেকবা পাঁচেও খেলানো হয়েছে। পাঁচ নম্বরে নেমে তিনি ১০ বলে করেছিলেন ৩ রান, ছয় নম্বরে নেমে ১৩ বলে ১৯ রান।
সৌম্যকে তাই আবারও লোয়ার অর্ডারে ট্রাই করার ভাবনাটা অনেকটা পুরনো ব্যার্থ এক্সপেরিমেন্ট অবুঝ ল্যাবমেটের মত আবারও করে যাওয়ার মত। একটা জায়গায় একজন প্রুভেন ফেইলিউরকে ট্রাই করা মনে হয়না খুব একটা কার্যকরী সিদ্ধান্ত হবে।
আবার সৌম্য যে নেমেই শুরু থেকে বোলারকে চার্জ করতে পারেন এমনটাও কিন্তু না। সৌম্যর সেই ২০১৫ এর মত স্বপ্নের বছরগুলি ধরেই বলছি, পাওয়ারপ্লে তে সৌম্যর ডট খেলার হার ৫৯.৪ শতাংশ।
আবার সৌম্যকে যদি একজন পেস-বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলানোর চিন্তাও করা হয়, সেটাও মনে হয়না খুব একটা ঠিক সিদ্ধান্ত হবে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেই ৮ ইনিংসে বল করে উইকেট নিয়েছেন মাত্র চারটে। এই সময়ে সৌম্যর ইকোনমি ছিল ৮.০৬! এমনকি প্রতি উইকেট নিতে তাকে দিতে হয়েছে ৪৫ রান করে। এমনকি ডিপিএল চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর বিপক্ষে তার দুই ম্যাচের বোলিং কার্ড হলঃ ২-০-২৩-১ এবং ৩-০-১৮-০। সবচেয়ে বেশি ওভার বল তিনি করেছিলেন গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স এবং শেখ জামাল ধানমন্ডির বিপক্ষে। এই দুই ম্যাচে সৌম্যর বোলিং কার্ড ছিল ৬-০-৫৩-০ এবং ৪-০-৪৪-১।
এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশের যে পেস বোলিং ইউনিট সেখানে সৌম্য আদৌ দরকারি কিনা সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
সৌম্যকে তাই কেন ডাকা হয়েছে এই প্রশ্নটি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমাকে স্রেফ তাই বলতে হবে,
“এমনি”
(Photo of Soumya Sarkar is collected)
#iccworldcup2023 #BangladeshCricketTeam #BangladeshCricket #soumyasarkar #AsiaCup2023 #odicricket #bcb #BangladeshCricketBoard #stats #CricketStats